Monday, July 25, 2011

আমাদের আকীদা কেমন হওয়া উচিত

একজন মুসলমানের আকীদা কেমন হওয়া উচিত

কোন বিষয়ে অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বা আকীদা বলা হয়। একজন মুসলমানের ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত সমূদয় বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের ধরনের ওপরই তার মুসলমানিত্বের আবস্থা নির্ভর করে। প্রকৃত মুমিন হতে হলে, আকীদা বিশুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। বিশুদ্ধ আকীদা ব্যতিরেকে প্রকৃত মুমিন হওয়া তথা ঈমানের পূর্ণতা লাভ করা সম্ভব নয়।

সাধারন মুসলমান যাতে ঈমানের বিষয়গুলো জেনে নিজ আকীদা বিশুদ্ধ ও দুরস্ত করতে পারেন, তাই আকীদা সম্পর্কিত মূল বিষয়গুলো অতি সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে পেশ করছি-

১। আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত অন্য সমুদয় দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তু সমূহ আল্লাহ পাকেরই সৃষ্টি। প্রথমে এসব বস্তুর কোনটিরই অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহ তা'আলা এগুলো সৃষ্টি করার মাধ্যমে এগুলোর অস্তিত্ব এসেছে।

২। আল্লাহ তা'আল এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কারো জনক নন এবং তাঁরও কোন জনক নেই। আল্লাহ পাকের তুল্য কিছু নেই। তিনি সর্বদাই সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পূর্বেও বর্তমান ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও বর্তমান থাকবেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই তাঁর নিকট সমান; তিনি সর্ববিষয়েই সম্যক অবগত। তিনি সবকিছু দেখেন, সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কিছুই নেই। তিনি সব রকমের দোষ-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং অতিপবিত্র। তিনিই একমাত্র মাবূদ; বান্দার বন্দেগী পাওয়ার তিনিই একমাত্র অধিকারী। তিনি সর্বশ্রেষ্ট। তিনিই সৃষ্টিকুলের রিযিক ও আহার দান করেন। তিনিই বান্দার গুনাহ মাফ করেন। তিনিই জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা। তাঁর নিদ্রাও নেই, তন্দ্রাও নেই। এ বিশ্বজাহানের একমাত্র তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, ত্রাণকর্তা, পালনকর্তা, বিধানদাতা ও একচ্ছত্র প্রকৃত মালিক। শেষ বিচারের দিনেরও তিনিই অধিপতি।

৩। আল্লাহ তা'আলার গুনবাচক অনেক নাম রয়েছে। তাঁর যাবতীয় গুণ পরিপূর্ণ ও চিরশ্বাশত।

৪। দুনিয়ায় ভাল ও মন্দ যা কিছু ঘটে, সবই আল্লাহ তা'আলার হুকুমেই ঘটে। আর তিনি এসব পূর্ব থেকেই অবগত।

৫। আল্লাহ তা'আলা মানুষ ও জ্বিন জাতিকে ভাল-মন্দ বোঝার উপযুক্ত বিবেক দান করেছেন এবং ইচ্ছামতো কর্ম করার শক্তি দান করেছেন। বান্দার ভাল কাজে আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন এবং বান্দার গুনাহের কাজে তিনি নারাজ ও অসন্তুষ্ট হন।

৬। আল্লাহ পাক মানুষকে তাদের শক্তির বাইরে কোন কাজ করার আদেশ প্রদান করেননি। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা ইসলামী শরীয়াতের মাধ্যমে যত আদেশ ও নিষেধমূলক হুকুম করাছেন, সেই সবই নিঃসন্দেহে মানুষের সাধ্যগত।

৭। আল্লাহ পাকের ওপর কোন কিছুই জরুরি অর্থাৎ ওয়াজিব নয়। তিনি বান্দার জন্য কল্যানমূলক যা-ই করেন, তা শুধু তাঁর দয়া বা অনুগ্রহ মাত্র।

৮। আল্লাহ তা'আলা মানুষ ও জ্বিন জাতিকে দ্বীনের সুপথ ও সৎপথ প্রদর্শনের জন্য একের পর এক অগণিত নবী রাসুল দুনিয়ায় প্রেরন করেছেন। তাঁরা সবাই নিষ্পাপ ছিলেন। তাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ তা'আলাই জানেন।

প্রেরিত নবী-রাসুল গনের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন হযরত আদম (আঃ) এবং সর্বশেষ হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনিই শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী দুনিয়ায় আগমন করবেন না।

৯। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে নয়, বরং বাস্তবে সশরীরে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে প্রথমে মক্কা শরীফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এবং সেখেন থেকে সাত আসমান ও আরশ মু'আল্লায় পরিভ্রমণ করেছেন। একে ইসলামী পরিভাষায় ইসরা ও মিরাজ বলা হয়।

১০। আল্লাহ তা'আলা নূর দ্বারা ফেরেশতাকুল সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা আমাদের অদৃশ্য। তাঁরা আল্লাহ পাকের আজ্ঞাবহ। তাদের সংখ্যা অগনিত। ফেরেশতাগনের মধ্যে চারজন প্রধান, তাঁরা হলেন-(ক) হযরত জিবরাইল (আঃ), (খ) হযরত মিকাঈল (আঃ) (গ) হযরত ইসরাফীল (আঃ) এবং (ঘ) হযরত আজরাইল (আঃ)।

১১। আমাদের দৃষ্টির বাইরে আল্লাহ পাকের সৃষ্ট আরেক জাতি হচ্ছে জ্বিন জাতি। তাদের মধ্যেও মানুষের মতই ভাল বা মন্দ অর্থাৎ নেককার ও বদকার উভয়রকম বিদ্যমান। বদকারদের মধ্যে ইবলীস শয়তান অন্যতম।

১২। আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাগনকে ওলী বলা হয়। তাদের কারামত(আলৌকিক কার্যাবলী) সত্য। তবে ওলী হওয়ার জন্য কারামত প্রকাশ পাওয়া জরুরি নয়। বরং দ্বীনের ওপর পরিপূর্ণ পাবন্দীই ওলী হওয়ার প্রমাণ।

ওলী কখনো নবীর সমান হতে পারেন না। তেমনিভাবে যিনি নবীজির সাহাবী নন, তিনি যিত বড় ওলীই হোন না কেন, তিনি কখনো কোন সাধারণ সাহাবীরও সমতুল্য হতে পারেন না।

১৩। শরীয়তের খেলাফকারী ব্যক্তি কখনোই ওলী হতে পারে না।

১৪। যুগে যুগে আল্লাহ তা'আলা ছোট বড় অনেকগুলো আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে চারখানা আসমানী কিতাব শ্রেষ্ঠ। যথাঃ (ক) তাওরাতঃ হযরত মূসা (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত। (খ) যাবুরঃ হযরত দাউদ (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত। (গ) ইঞ্জিলঃ হযরত ঈসা (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত এবং (ঘ) পবিত্র কুরআন মাজীদঃ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর নাযিলকৃত।

১৫। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবীগন (রাঃ) আল্লাহ তা'আলার বিশেষ সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত। তাঁরা হকের মাপকাঠি। অর্থাৎ তাদের অনুসরণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুসরনের শামিল। কেননা তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পূর্ণাজ্ঞ আনুগত্যকারীরুপে নির্বাচিত করেছেন এবং তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পদাংজ্ঞ অনুসরন করে জীবন ধন্য করেছেন। তাই তাঁরা দুনিয়াতে থাকতেই মহান আল্লাহ কত্রৃক সন্তুষ্টির সুসংবাদ লাভ করেছেন।

১৬। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহল বা পরিবারবর্গ তথা স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা এবং তাঁদের মুবারক রক্তধারার সকলের প্রতি মহব্বত রাখা জরুরী।

১৭। আল্লাহ পাকের সমুদয় ঘোষনা (কুরআনের ইরশাদ) এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সকল কথা(হাদীসসমূহ) সত্য বলে বিশ্বাস করা অপরিহার্য ও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। এটা ব্যতিত ঈমান পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।

১৮। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করা যাবে না। অর্থাৎ সুবিধামতো তাঁর অর্থ-ব্যাখ্যা প্রদান করা কিংবা বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা যাবে না। বরং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)থেকে শিক্ষালাভ করে সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়ীন ও তাবেয়ীনগন (রহঃ) কুরআন ও হাদীসের যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন পেশ করেছেন, তা-ই গ্রহণ করতে হবে।

১৯। কোন ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাবকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। তেমনিভাবে কোন গুনাহকে হালাল তথা বৈধ জ্ঞান করা যাবে না।

২০। আল্লাহ পাকের আযাবের ভয় থেকে আতংকমুক্ত হওয়া যাবে না এবং আল্লাহ পাকের রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না।

২১। অদৃষ্টের কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা এবং অদৃষ্টের ব্যাপারে কারো উক্তি বিশ্বাস করা যাবে না।

২২। অদৃষ্ট ও গাইবের খবর একমাত্র আল্লাহ পাকই অবগত রয়েছেন। তিনি ছাড়া অন্যকেউ গাইবের বিষয়ে অবগত নয়। আর আল্লাহ তা'আলার জানানো ছাড়া কোন সৃষ্টিজীবের পক্ষে গাইবের কোন বিষয় জানা সম্ভব নয়।

২৩। কেউ মৃত্যুবরণ করলে, তাকে দাফন করা হলে অথবা দাফন করা সম্ভব না হলেও উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ পাকের দু'জন ফেরেশতা মুনকার ও নাকীর তার নিকট আগমন করেন এবং তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার মাবূদ কে? তোমার দ্বীন(ধর্ম) কী? এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, ইনি কে? যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়, এবং সঠিক জবাব দেয়, তখন আল্লাহ পাকের দয়ায় তার জন্য জান্নাতের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা হয়। পক্ষান্তরে মৃত ব্যক্তি ঈমানদার না হলে বা বদকার হলে, ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের জবাবে সে বলে, "আমি জানি না, আমি জানি না"। তখন তাকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দেয়া শুরু হয়-যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবত থাকে।

২৪। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র হাদীসে কিয়ামতের যে সমস্ত আলামত বর্ণনা করেছেন, তা অবশ্যই ঘটবে। যেমন, হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) দুনিয়ায় আগমন করবেন, হযরত ঈসা (আঃ) আসমান থেকে অবতরন করবেন, কানা দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং ঈসা (আঃ) দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ইয়াজুজ-মাজুজ নামক এক জাতি দুনিয়ায় ছড়িয়া পড়বে, 'দাব্বাতুল আরয' নামক এক অদ্ভুত জীব আবির্ভূত হবে এবং মানুষের সাথে কথা বলবে, হঠাত একদিন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদয় হয়ে আবার পশ্চিম দিকেই অস্ত যাবে এবং তখন তবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, পবিত্র কুরআন মাজীদ উঠএ যাবে এবং সমস্ত ইমানদার লোকেরা প্রাণত্যাগ করবে; তখন শুধু কাফিররাই দুনিয়ায় বিদ্যমান থাকবে, আর সেই অবস্থায়ই কিয়ামত কায়েম হবে।

২৫। কিয়ামতের সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরেই হযরত ঈসরাফীল (আঃ) শিঙ্গায় ফুক দিবেন। তখন সমস্ত আসমান ও যমীন ফেটে টুকরো  টুকরো হয়ে যাবে এবং পাহাড়্গুলো তুলার মত উড়তে থাকবে। সেসময় বিদ্যমান যাবতীয় জীব মারা যাবে। সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ থাকবে না। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন অতিবাহিত হবে।
অত;পর দ্বীতিয়বার সিঙ্গায় ফুক দেয়া হবে। তখন আলম জীবিত হয়ে উঠবে। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্তের সমস্ত মৃত লোক জীবিত হয়ে কিয়ামতের ময়দানে একত্রিত হবে।
তখন নেকী ও বদী পরিমাপের পাল্লা (মিযান) স্থাপন করা হবে এবং মানুষের কার্যসমূহ মাপা হবে। কেউ কেউ বিনা হিসেবে বেহেশতে গমনের অনুমতিপ্রাপ্ত হবেন। নেককারদের আমলনামা তাঁদের দান হাতে এবং বদকারদের আমলনামা তাঁদের বাম হাতে দেয়া হবে।
সেদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় উম্মতদেরকে হাউজে কাউসারের শরবত পান করাবেন।
সকলেই পুলসিরাত পার হতে হবে। নেককারগন পুলসিরাত পার হয়ে আল্লাহ পাকের দয়ায় জান্নাতে গমন করবেন এবং পাপীরা পুলসিরাতে উপর থেকে নীচে অবস্থিত জাহান্নামে পতিত হবে।

২৬। -----------------------চলবে। 

1 comment: