Tuesday, October 18, 2011

প্রতিশ্রুতি পূরণ


প্রতিশ্রুতি পূরণ

মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের শাহী মহল। ভেতরে জরুরী বৈঠক বসেছে। চারদিকে সতর্কতার সাথে পাহারা দিচ্ছে প্রহরীরা।
দিল্লীর আকাশ থেকে দূর্যোগের ঘনঘটা এখনও কাটেনি। কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে বিখ্যাত চৌসার যুদ্ধ। সেখান থেকে স্বয়ং রাজাকেই কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে। শাহী মহলের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলো এক প্রহরী। হঠাত তার দৃষ্টিতে পড়লো এক ভিস্তিওয়ালা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে প্রধান ফটকের দিকে। পরনে ছেড়া-ময়লা জামা। কাঁধে বহন করছে ছাগলচামরার ভিস্তি।
সন্দেহের দোলায় দুলে উঠলো প্রহরীর মন। কোন গুপ্তচর নয় তো। পাগলও হতে পারে। হাঁক ছেড়ে ভিস্তিওয়ালার গতি থামিয়ে দিলো প্রহরী। চরা গলায় জানতে চাইল, কাকে চাই? যাচ্ছ কোথায় তুমি? শান্ত ও ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো ভিস্তিওয়ালা, ‘আমাকে বাদশাহর কাছে নিয়ে চলো’।
অট্রহাসি দিয়ে প্রহরী বললো, ‘ফকির সাহেব! বাদশাহর সাথে দেখা করতে চাও? শখ তো দেখি কম না! ভাগো এখান থেকে’।
কিন্তু ভিস্তিওয়ালা নাছোড় বান্দা। সে জোর দিয়ে বললো, আমাকে বাদশাহর কাছে নিয়ে যাও।
এবার প্রহরী ক্রুদ্ধ হয়ে ভিস্তিওয়ালাকে আটকে রেখে বাদশাহর কাছে খবর পাঠালো- জাহাপনা এক ভিস্তিওয়ালা আপননার সাথে দেখা করতে চায়।
কর্মব্যস্ত বাদশাহ হুমায়ুন আদেশ দিলেন- তাঁকে এক্ষুণি পাঠিয়ে দাও।
রাজশিংহাসনে বসে আছেন বাদশাহ হুমায়ুন, রাজদরবারে প্রবেশদ্বার দিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো ভিস্তিওয়ালা। আশা নিরাশার দ্বন্দে দোদুল্যমান তার মন। কাঁধে এখনও চেপে রেখেছে সেই ছাগলচামড়ার ভিস্তিটি।
হুমায়ুনের দৃষ্টি ছুটে গেল ভিস্তিওয়ালার দিকে। সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক তোলপাড় করে উঠলো। পুরনো কিছু স্মৃতি হানা দিলো তাঁর মগজের শিরা-উপশিরায়। ‘আরে! এতো সেই মহান লোক- যিনি আমার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন’। হুমায়ুনের চোখে ভেসে উঠলো সেই খরস্রোতা নদীর ঘটনা।
একবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত্রুর তাড়া খেয়ে এ নদীতেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি। ফলে প্রাণ বাচানো দায় হয়ে পড়েছিলো। সেই সময় এই ভিস্তিওয়ালা তাঁর ছাগলচামড়ার এই ভিস্তি দিয়ে সাঁতার কাটতে সাহায্য করেছিলো। এই ভিস্তির উপর ভর করেই তিনি কূলে উঠে এসেছিলেন। সে সময় তাঁর প্রাণ রক্ষাকারীকে বলেছিলেন-“আমি যদি দিল্লীর সিঙ্গহাসন পাই, তুমি দেখা করবে। তুমি যা চাইবে, আমি তা-ই উপহার দেব”। এখন সেই ভিস্তিওয়ালা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। আর ভাবতে পারলেন না হুমায়ুন। স্বররণখচিত সিংহাসন ছেড়ে ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ময়লা জামা পরিহিত ভিস্তিওয়ালাকে। জড়িয়ে ধরেই ব্যাকুল কন্ঠে বললেন, ‘মহামান্য, আমি আপনার দ্বারা উপকৃত। বলুন, আপনি কি চান? আপনি যা চাইবেন, আমি ইনশাআল্লাহ্‌ বিনা-দ্বিধায় তাই দেব’।
ভিস্তিওয়ালা বললো, ‘আমি চাই আপনাকে সরিয়ে সিঙ্ঘাসনে বসতে’সমস্ত সবাসদ অবাক! লোকটির চাহিদার কথা শুনে সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। লোকটি পাগল নাকি। একেবারে রাজসিঙ্ঘাসন চেয়ে বসলো! দেখা যাক বাদশাহ কি করেন।
এবার বিস্ময়ের ঘোরে সবাই লক্ষ্য করলো, প্রতাপশালী মোঘল সম্রাট হুমায়ুন মাথার মুকুট খুলে সম্মানের সাথে পরিয়ে দিচ্ছেন ভিস্তিওয়ালার মাথায়। নতুন রাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে ঘোষনা করলেন, আজ থেকে ইনিই তোমাদের রাজা। আমি তাঁর নগন্য খাদেম।
গোটা দিল্লীতে তোলপাড়। প্রজাদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হচ্ছেন হুমায়ুন। কেন তিনি সিংহাসন ছেরে দিলেন?
হুমায়ুন উত্তর দিলেন, ‘হাদীস শরীফে আছে, মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি। তারমধ্যে একটি হচ্ছে- প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। আমি তো নদীতে ডুবে মারা যেতাম-যদি এই ভিস্তিওয়ালা সাহায্য না করতেন। তার উপকারের বদলায় তিনি যা চাইবেন তা-ই দেব বলে কথা দিয়েছিলাম। সেজন্য সিংহাসন চাওয়াই আমি তাঁকে তা-ই দিলাম’।
অবশেষে একদিন ও একরাত্রি যাপনের পর ভিস্তিওয়ালা হুমায়ুনের মাথায় পুনরায় মুকুট পরিয়ে দিলো। হুমায়ুনকে সিংহাসনে বসিয়ে হাত তুলে দু’আ ও করমর্দন করে বললো, ‘আমি বড় পুরষ্কার পেয়েছি। তা হচ্ছে-আপনার মহানুভবতা ও চরিত্রের দৃঢতা’।
আসুন  আমরা আমদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চেষ্টা করি।

No comments:

Post a Comment